Saturday, December 2, 2017

বীরাঙ্গনার কষ্ট কথন

 😰বীরাঙ্গনার কষ্ট কথন 😰 

মাগো, তোমার বুকের উপর জারজের শক্ত বুটের দাপাদাপিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার, তাই না মা ? আমারও হয়েছে, হচ্ছে । কিন্তু সেই খবর কি ওরা রাখে মা ? কেউ কি জানতে চায় আমাদের কথা ? আমাদের বুকের কষ্টটা ওরা কি কেউ ছুঁয়ে দেখে ? কেন দেখে না মা ? তখন আমি সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী । সমিরণ নামের আমাদের ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের একটা ছাত্রের সাথে খুব সখ্যতা হয় আমার । বুঝতেই পারিনি কখন তা ভালোবাসায় রূপ নেয় । এখনও মনে আছে, একদিন সমিরণ মজা করে আমাকে বাসর রাতের স্বপ্নের কথা বলেছিল । কি লজ্জাই না পেয়েছিলাম সেদিন । লজ্জায় তিন দিন ওর সাথে কথাই বলতে পারিনি আমি। সমিরণও বুঝেছিল সেটা । তাই আর ওসব কথা বলেনি কোনদিন । পাগলটা সারাদিন মিছিল, মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। হঠাৎ একদিন বললো যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী । কেমন জানি পালটে যেতে লাগলো সে। এরপর একদিন গায়েব ! কোন কিছু না বলেই উধাও হয়ে গেল ।
 আমরা কয়েকজন বান্ধবী আর তানিয়া আপু মিলে মোহাম্মদপুরে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম । আত্মীয়ের বাসা । তখন এভাবে কয়েকজন মেয়ে মিলে বাসা ভাড়া করে থাকার রেওয়াজ ছিলনা । কিন্তু এই বাসাটা আমার চাচার । খালি বাসা দেখে চাচা আমাকে থাকতে বললেন। ভাড়া দিয়ে থাকার শর্তে আমি রাজি হলাম থাকতে । একা এতো টাকা দেয়াটা একটু সমস্যা হবে ভেবে কয়েকজন বান্ধবীকে সাথে নেই । চাচাও তাতে কোন আপত্তি করেননি । তানিয়া আপু'র ছোট বোন শিউলি এসেছিল কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে । খুব মিষ্টি দেখতে । মাত্র অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে । ২৫ আর ২৬ মার্চ ঢাকায় যে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে, তাতে করে আমদের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । চাচা বলেছিলেন আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দিবেন । অবস্থা একটু ঠাণ্ডা হলেই সবাই বাড়ি চলে যাব । কিন্তু কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছিল-না সব কোনদিন ঠাণ্ডা হবে । তবুও আশায় বুক বেঁধেছিলাম ।
৩১ মার্চ সন্ধ্যা বেলা হঠাৎ চাচার ঘর থেকে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ আসে । ভয়ে আঁতকে উঠি । ঠিক দু'তিন মিনিট পরেই আমাদের দরজায় লাথি মারে ওরা । দরজা ভেঙ্গে ঢুকে যায় ঘরে । মনে হচ্ছিল যেন মৃত্যু-দূত স্বয়ং উপস্থিত আমাদের সামনে । চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গাড়িতে তোলে আমাদের ৯ জনকে । শিউলিকে একটা থাপ্পড় দিতেই সে অজ্ঞান হয়ে যায় । ওকেও উঠায় গাড়িতে । এরপর নিয়ে যায় ক্যাম্পে । দেখলাম আরও কয়েকজন আমাদের আগে থেকেই ওখানে বন্দী আছে । কারো শরীরে কাপড় নেই । রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে । শিউলিকে ওরা অন্য কোথাও নিয়ে গেছে। আমাদের সাথে রাখেনি। হঠাৎ ৩/৪ জন আসে আমাদের ঘরে। বেছে বেছে কয়েকজনকে টানতে টানতে কোথায় যেন নিয়ে যায়। এরপর আবার আসে, নিয়ে যায় আমাকে ।
তাজা মাংসের স্বাদ নিতে আমার উপর হামলে পড়েছিল হিংস্র দাঁতাল রাক্ষস । বুকের উপর চালাতে থাকে কোদাল। ধারালো কাস্তের মতো নখ আর লালা ঝরা কোদালের মত দাঁত দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে আমাকে । মনে হয়েছিল আমার শরীরটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র । যুদ্ধে ওদের জিততেই হবে । সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার উপর । এক, দুই, তিন... এরপরে আর মনে নেই । সেইদিন থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের বুকের উপর হায়েনাদের উদ্দাম নৃত্য । প্রভুর আহার শেষে উচ্ছিষ্টটুকু খেতে আসতো তাদের শিষ্যরা । এরপর তাদের শিষ্যরা । তুমুল নির্যাতনে মাটি ভিজে লাল হয়েছে বহুবার । করুণা ভিক্ষা চেয়ে পেয়েছি দ্বিগুণ নির্যাতন । নির্যাতনের ধরনটা একেক জনের বেলায় একেক রকমের হতো । কখনো বন্দুকের গরম নলা, কখনো গরম গরম সেদ্ধ ডিম, কখনো বা সোজা বেয়নেট ঢুকিয়ে দিত যোনি পথে । বুকে ছুরি চালাতো । আরো কতো অত্যাচার, কতো ধরনের নির্যাতন...
শিউলিকে দেখেছি ৪ দিন পরে অর্ধ মৃত অবস্থায় । বিবস্ত্র শিউলিকে অচেতন অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল আমাদের অন্ধকার খাঁচায় । পুরো শরীর জুড়ে ক্ষত আর ক্ষত । পশুগুলো ওর বুকটাও কেটে চিরে খেয়েছে । যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চঞ্চল শিউলি কখন যেন ঠাণ্ডা নিথর মাংস পিণ্ডে পরিণত হয়েছিল তা আমরা কেউ টেরও পাই নি ।
প্রতিদিন নতুন নতুন মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতো । প্রতি বেলায় অন্তত ৮ থেকে ১০ জন আসতো আমাদের ঘরে বন্দী হয়ে । নতুনেরা আসলে পুরাতনদের উপর অত্যাচারটা কিছুটা কম হতো । যারা ওদের কথা মতো কাজ করতো না বা ওদের মনোরঞ্জন করতে ব্যর্থ হতো তাদের গুলি করে মেরে ফেলতো । যারা এরই মাঝে গর্ভবতী হয়েছিল তাদেরকে ওরা তেমন নির্যাতন করতো না । একটা সময় টের পেলাম আমিও ওদের দলে নাম লিখিয়েছি । ততদিনে প্রায় ৬ মাস গত হয়েছে । মনে মনে ভাবতে থাকি একটা সময় যে আমি বাসর রাতের স্বপ্নের কথা শুনেই লজ্জা পেয়েছিলাম, সেই আমাকেই আজ প্রতি বেলায় বাসর সাজাতে বাধ্য করে ওরা । চিৎকার দিয়ে কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারি না । চোখের জল সব শুকিয়ে গেছে । আর্ত-চিৎকার ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না আমার মাঝে, আমাদের মাঝে ।
একদিন মুক্তিবাহিনী হামলা করে এই ক্যাম্পে । জয়ী হয়ে মুক্তি দেয় আমাদের । পরে জানতে পেরেছিলাম সেদিন ছিল ১৬ তারিখ । ১৬ই ডিসেম্বর । আমরা প্রায় ১০০ জন জীবিত অবস্থায় সেদিন মুক্ত হয়েছিলাম । মুক্তি পেয়ে ছুটে যেতে চাই বাইরে । কিন্তু পারি না । শরীরে সেই শক্তিটা আর অবশিষ্ট নেই । তবুও যাই বাইরে । কিছুদিন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে যাই বাড়িতে । কেউ নেই । ঘর বলতে কিছু নেই । পাশেই আরেক চাচার বাসা । চাচা বেঁচে আছেন । আর কেউ নে ই। চাচা আমাকে গ্রহণ করেননি । তাড়িয়ে দিয়েছিলেন । বাপের ভিটা আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম । কিন্তু চাচা আর গ্রামের মুরুব্বিরা আমাকে থাকতে দেয়নি । আমাকে তাড়িয়ে তারা গ্রামকে আবর্জনা মুক্ত করেছে !
সেইদিন বুঝতে পেরেছিলাম এটা আমার দ্বিতীয় যুদ্ধের শুরু মাত্র । এই যুদ্ধে টিকে থাকতে হলে অসীম সাহসিকতা আর দৃঢ় মনোবল প্রয়োজন । কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম । কিছু বিদেশী সংস্থা এবং সরকারী খরচে অনেক নির্যাতিতা মেয়ের গর্ভপাত ঘটানো হয় । কিন্তু আমার সেই অবস্থাও ছিল না । তাই কিছুটা সুস্থ হয়ে সেখান থেকে চলে আসতে হয়েছিল । তারও কিছুদিন পরে আমার জায়গা হয়েছিল একটি পতিতালয়ে । যদিও তখন সমগ্র বাংলাদেশই একটি পতিতালয় ছিল । সেখানে একজন বয়স্ক মহিলা ছিলেন । জামেলা বিবি নাম ছিল তাঁর । তাঁর আশ্রয়ে সেখানে বাকিটা সময় থাকার সুযোগ পাই । সেখানেই আমার সন্তানের জন্ম হয় । নাম রাখি "বিজয়" ।
বিজয়ের জন্মের কয়েক মাস পর কিছু লোভাতুর পাষণ্ডের চোখ পরে আমার উপর । জামেলা বিবিও তখন আর বেঁচে নেই । তাই সেখান থেকে পালাতে হয় । একদিন শুনেছিলাম জাতির জনক নাকি বলেছিলেন, “তোরা আমার মা, তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা, আমি আছি, তোদের আর চিন্তা কি ? কিন্তু সেই শোনাটাই শেষ । এখন বুঝি, যে জাতি জাতির জনককেই অস্বীকার করছে সে জাতি তাঁর মা'কে স্বীকার করবে কিভাবে ? একটি বিদেশী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করলে তারা ছোট একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয় । সারাদিন কামলা খেটে একবেলার খাবার এনে দিয়েছি আমার সন্তানের মুখে । সে কিছু জানে না, বুঝে না । আমার মুখের দিকে ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকে আর চারদিকে কি যেন খোঁজে ! কোন প্রশ্ন নেই, নেই কোন উত্তর ।
পরে শুনেছিলাম দেশে বীরাঙ্গনাদের তালিকা করা হচ্ছে । সরকার একদিন ঘোষণা দিল প্রায় দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে । সত্যি কি দুই লক্ষ ছিল ? সরকার কিসের ভিত্তিতে সেটা নির্ধারণ করেছিল ? কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থার হিসাবে সেই সংখ্যা প্রায় চার লাখ । সত্যিই কি কেউ সঠিক হিসাবটা দিতে পারবে ? কিসের ভিত্তিতে করবে এই হিসাব ? কোন বীরাঙ্গনার সন্তান বা পরিবার কি বলবে আমার পরিবারে একজন বীরাঙ্গনা আছে ? কেউ কি স্বীকার করে ? কোন বীরাঙ্গনাকে কি স্বীকার করতে দেয়া হয় সেই কথা ? লজ্জা, অপমান আর গ্লানি থেকে দূরে থাকতে গিয়ে সবাই চেপে যায় এই ত্যাগী সন্তানদের কথা । কতজন একাত্তর পরবর্তী সময়ে অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে তার সঠিক কোন হিসাব আছে কারো কাছে ? রাজাকাররা কতো মেয়েকে নির্যাতন করে লাশ বানিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছে সেই হিসাব কেউ রেখেছে ? কতজনকে নির্যাতন করে মিলিটারিরা একসাথে কবর দিয়েছে সেই হিসাব কারা রেখেছে ? কিসের ভিত্তিতে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল ?
মাগো, ওরা ভুলে গেছে আমাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা লিখা হয়েছিল । আমাদের কাপড় খুলেছিল বলেই আজ ওরা স্বাধীন বাংলায় কাপড় পড়ে সভ্য সাজে । আজ বুদ্ধিজীবীদের, শহীদদের সবাই সম্মান জানায় । কিন্তু আমাদের কোন সম্মান নেই ! রাষ্ট্রের কাছে আমরা আজ শুধুই একটা সংখ্যা ! পাকিস্তানী দালালদের ওরা "পাকি বীজ" বলে গালি দেয় । গালিটা কি আমাদের একটু হলেও ছুঁয়ে যায়না মা ? রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা কোটা করেছে, আছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ । কিন্তু আমাদের কোন কোটা নেই । মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কতকিছু হয় এই দেশে, কিন্তু আমাদের কোন সনদ নেই । আমার ছেলেটা তার মায়ের অতীত পরিচয় দিতে পারেনা । তার জন্মের ইতিহাস বলতে পারেনা । সমাজ তাকে লজ্জা দেয়, বাঁকা চোখে তাকায় । মুক্তিযোদ্ধা পরিবার গর্ব করে মাথা উঁচু করে বাঁচে । আর আমার ছেলে সেই পরিচয় দিতে লজ্জা পায় । ওরা বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেছিল, আর আমরা আমাদের সম্ভ্রম দিয়ে । তোমার সবুজ শাড়ির লাল আঁচলে আমাদেরও-তো রক্ত আছে মা । তাহলে কেন এই বৈষম্য ?
রাষ্ট্র আজ বিদেশী শহীদ বন্ধুদের সম্মানার্থে স্মৃতিস্তম্ভ বানাবে । সম্মান করি এই উদ্যোগের । কিন্তু আমাদের জন্য কি করেছে রাষ্ট্র ? আমাদের সম্মানটা কোথায় ? মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আমরা কেন পারি না নিজেদের পরিচয় গর্ব করে বলতে ? স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় আমাদের অবদান কেন মূল্যায়িত হয় না ? কেন আমাদের পরিচয় দিতে গেলে সবাই লজ্জায় মুখ লুকায় ? চুয়াল্লিশ বছর ধরে আমরা বীরের 'অঙ্গনা' হয়েই পরিচিত হয়ে এসেছি । কেন ? আমাদের আলাদা কোন পরিচয় নেই ? আমরা কি বীর না ? বীরের নারী হয়ে কেন থাকবো ? আমাদের কি বীর বলা যায়না ? বীরের সম্মান কি আমাদের প্রাপ্য না ? বীর মানেই পুরুষ ! আর নারী মানেই অঙ্গনা ! কেন এই বৈষম্য ?
আজ যখন দেখি জাতীয় কুলাঙ্গারদের বিচার করতে গেলে এই জাতিই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, বাঁধা দিতে চায়, বিচারের বিরোধিতা করে, তখন ইচ্ছা হয় কোন এক টাইম মেশিনে ওদের বসিয়ে নিয়ে যাই সেই অন্ধকার বন্দীশালায় । আমাদের যন্ত্রণার সবটুকু বিষ ঢেলে দেই এই বেইমান জাতির ভিতর । আমাদের আর্তনাদ আর চাপা কষ্ট ওরাও জানুক, অনুভব করুক ।
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে কতজন নির্যাতিতা নারীই বা বেঁচে আছেন ! কতজন আছে যারা ঠিক মতো কথা বলতে, চলাফেরা করতে পারেন ! আমরা কি আমাদের যথার্থ মর্যাদা আশা করতে পারিনা রাষ্ট্রের কাছে ? আমরা কি এভাবে শুধু সংখ্যা হয়েই বেঁচে থাকবো ? আমরা কি আদৌ জীবদ্দশায় নিজেদের সম্মানজনক অবস্থায় দেখে যেতে পারবো না ?